হজম শক্তি বাড়ানোর ঘরোয়া উপায়

মানুষের শরীর সুস্থ ও কর্মক্ষম রাখার মূল চাবিকাঠি হলো সঠিক হজম ক্ষমতা। আমরা প্রতিদিন যত খাবার খাই, সেগুলো যদি ঠিকভাবে হজম না হয়, তবে শরীরে পুষ্টি পৌঁছায় না এবং বিভিন্ন অসুস্থতা দেখা দেয়। বর্তমানে অনেকেই হজমজনিত সমস্যায় ভুগছেন—যেমন গ্যাস, অম্বল, পেট ফাঁপা, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি। ওষুধের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার বদলে কিছু সহজ, সস্তা ও কার্যকর ঘরোয়া উপায় অবলম্বন করেই হজম শক্তি বাড়ানো সম্ভব। আজকের আলোচনায় আমরা এমন কিছু ঘরোয়া উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো, যা নিয়মিত পালন করলে হজমশক্তি বৃদ্ধি পায় এবং শরীর সুস্থ থাকে। তো চলুন শুরু করা যাক ।

হজম শক্তি বাড়ানোর ঘরোয়া উপায় যেগুলো চাইলে আপনি খুব সহজেই ফলো করতে পারেন ।

১. খালি পেটে আদা ও লবণ

প্রাচীনকাল থেকেই আদাকে হজমের জন্য মহৌষধ হিসেবে ধরা হয়। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে এক টুকরো কাঁচা আদার সঙ্গে এক চিমটি লবণ চিবিয়ে খেলে পেটে পাচক রস নির্গত হয়, যা হজম প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। এটি বমি বমি ভাব, পেটের গ্যাস ও অম্বল প্রতিরোধেও সাহায্য করে।

২. জিরার পানি

জিরা শুধু রান্নার স্বাদ বাড়ায় না, বরং এটি হজমের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এক চা চামচ জিরা সারা রাত ভিজিয়ে রেখে সকালে সেই পানি পান করলে হজম শক্তি বৃদ্ধি পায়। এটি পাকস্থলীতে এনজাইম নিঃসরণে সহায়তা করে এবং পেটের অস্বস্তি দূর করে।

৩. পুদিনা পাতা

পুদিনা পাতা একটি প্রাকৃতিক হজম বর্ধক। পুদিনা পাতার রস বা চা হজমে সহায়তা করে, পাশাপাশি পেটের গ্যাস, ব্যথা এবং বদহজম কমাতে কার্যকর। প্রতিদিন খাবারের পর পুদিনা চা পান করলে হজমে আরাম পাওয়া যায়।

৪. ত্রিফলা চূর্ণ

ত্রিফলা হলো তিনটি ফল—হরিতকি, বহেরা ও আমলকী—এর সংমিশ্রণ। এটি আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি উপাদান। রাতে ঘুমানোর আগে এক গ্লাস কুসুম গরম পানিতে এক চামচ ত্রিফলা চূর্ণ মিশিয়ে খেলে হজমশক্তি বাড়ে এবং সকালে ভালোভাবে মলত্যাগ হয়।

৫. ঘি ও গরম ভাত

অনেকেই ঘি খেতে ভয় পান, কিন্তু সঠিক পরিমাণে খাঁটি গরুর দুধের ঘি হজমে সহায়ক। গরম ভাতের সঙ্গে এক চামচ ঘি মিশিয়ে খেলে অন্ত্রের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়। তবে অতিরিক্ত না খেয়ে পরিমাণমতো খাওয়াই উত্তম।

৬. গরম পানি ও লেবু

প্রতিদিন সকালে খালি পেটে হালকা গরম পানির সঙ্গে এক চামচ লেবুর রস ও এক চিমটি কালো লবণ মিশিয়ে পান করলে হজম প্রক্রিয়া সুসংগঠিত হয়। এটি লিভারকে উদ্দীপিত করে এবং শরীর থেকে টক্সিন বের করে দেয়।

৭. ছোলা বা ভেজানো বাদাম

সকালে খালি পেটে ৮–১০টি ভেজানো ছোলা বা বাদাম খেলে শরীরে প্রোটিন ও ফাইবার সরবরাহ হয়, যা অন্ত্র পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। এটি হজম প্রক্রিয়াকে মসৃণ রাখে এবং দীর্ঘমেয়াদে হজমশক্তি উন্নত করে।

৮. দই ও মাখন

দই একটি প্রাকৃতিক প্রোবায়োটিক খাবার। এতে থাকা উপকারী ব্যাকটেরিয়া অন্ত্রে উপকারী জীবাণু বাড়িয়ে হজমশক্তি উন্নত করে। প্রতিদিন এক বাটি টক দই অথবা খাবারের সঙ্গে একটু মাখন খেলে পেট ঠাণ্ডা থাকে এবং হজম ভালো হয়।

৯. মৌরি বা সাউফ

খাওয়ার পর এক চিমটি মৌরি চিবিয়ে খেলে তা মুখের দুর্গন্ধ দূর করার পাশাপাশি হজমে সাহায্য করে। মৌরিতে থাকা তেল পাচক রস উৎপন্ন করে এবং পেট ফাঁপা বা গ্যাস কমায়।

১০. নিয়মিত ব্যায়াম ও হাঁটা

শুধু খাবার খাওয়াই নয়, খাবার হজমের জন্য হালকা ব্যায়াম, যেমন হাঁটা, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন অন্তত ২০–৩০ মিনিট হাঁটলে অন্ত্রের চলাচল স্বাভাবিক থাকে এবং খাবার দ্রুত হজম হয়। বিশেষ করে খাবারের পর কিছুক্ষণ হাঁটলে হজমশক্তি অনেকটা বেড়ে যায়।

১১. চিনি ও প্রসেসড খাবার এড়িয়ে চলা

অতিরিক্ত চিনি, ফাস্ট ফুড, তেলযুক্ত ও প্রসেসড খাবার হজমের শত্রু। এসব খাবার হজমকে ধীর করে দেয় এবং গ্যাস, অম্বল বা কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণ হয়। তাই এসব খাবার যতটা সম্ভব পরিহার করাই ভালো।

১২. ভেষজ চা

তুলসী, আদা, পুদিনা বা চিরতার মতো ভেষজ উপাদান দিয়ে তৈরি চা হজম শক্তি বাড়াতে দারুণ কার্যকর। এই চাগুলি অন্ত্রকে পরিষ্কার রাখে, পাচক রস বৃদ্ধি করে এবং পেটের অস্বস্তি কমায়।

১৩. পানির সঠিক ব্যবহার

অনেকেই খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশি পানি পান করেন, যা হজমে ব্যাঘাত ঘটায়। খাবারের অন্তত ৩০ মিনিট আগে বা পরে পানি পান করাই হজমের জন্য উপকারী। দিনে অন্তত ৮–১০ গ্লাস পানি পান করতে হবে যাতে শরীর হাইড্রেটেড থাকে এবং পাচনতন্ত্র ভালোভাবে কাজ করতে পারে।

১৪. আয়ুর্বেদিক উপায়: হিঙ্গ (হিং)

হিং বা হিঙ্গকে বাংলায় হিং বলা হয়। এটি পাকস্থলীতে গ্যাস উৎপাদন বন্ধ করে এবং হজমে সহায়তা করে। এক চিমটি হিং গরম পানিতে মিশিয়ে খেলে বা রান্নায় ব্যবহার করলে এটি পেট ফাঁপা কমায় এবং হজম ভালো করে।

১৫. চিবিয়ে খাওয়ার অভ্যাস

অনেকেই দ্রুত খাওয়ার অভ্যাসের ফলে সঠিকভাবে চিবিয়ে খেতে পারেন না। এতে খাবার ভালোভাবে হজম হয় না এবং গ্যাস বা অম্বলের সমস্যা দেখা দেয়। প্রতিটি খাবার ধীরে ধীরে চিবিয়ে খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুললে হজমশক্তি স্বাভাবিকভাবে বাড়ে।

হজম শক্তি বাড়ানো কোনো জাদুকরি ব্যাপার নয়। এটি একটি ধৈর্য ও নিয়মিত অভ্যাসের বিষয়। দৈনন্দিন জীবনে কিছু সহজ ঘরোয়া উপায় অবলম্বন করলে ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, পরিমিত খাওয়া এবং শরীরচর্চা করলে হজমজনিত প্রায় সব সমস্যার সমাধান সম্ভব। ওষুধের উপর নির্ভরতা না বাড়িয়ে ঘরে বসেই এই উপায়গুলো মেনে চললে শরীরের সামগ্রিক সুস্থতা বজায় থাকবে এবং হজমের সমস্যাও অনেকাংশে কমে যাবে।

নিয়মিত হাটুন সুস্থ্য থাকুন । তো আজ এ পর্যন্তই । আল্লাহ হাফেজ ।

No comments

Powered by Blogger.