কিডনি যেভাবে ভালো রাখবেন

 

কিডনি—আমাদের শরীরের এক নিঃশব্দ রক্ষাকর্তা। প্রতিদিন ১৭০ থেকে ১৮০ লিটার রক্ত ছেঁকে শরীরকে দূষণমুক্ত রাখে এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গদুটি। কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখি, কিডনি যদি একদিন ঠিকমতো কাজ না করে? হ্যাঁ, কিডনির অসুখ খুবই নিঃশব্দে শুরু হয়, কিন্তু একবার শুরু হলে তা নিয়ন্ত্রণে আনতে সময়, অর্থ ও ভোগান্তি—সবকিছুরই বড় মূল্য দিতে হয়। তাই আগেভাগেই সচেতন হওয়া এবং কিছু সহজ অভ্যাস মেনে চলাই পারে আমাদের কিডনিকে সুস্থ ও কর্মক্ষম রাখতে। এই আলোচনাতে আমরা জানব কীভাবে আপনি আপনার কিডনিকে ভালো রাখতে পারেন প্রাকৃতিক উপায়ে, কিছু নিয়ম মেনে এবং কিছু ভুল এড়িয়ে চলেই। চলুন শুরু করি কিডনি সুস্থ রাখার দিকগুলো নিয়ে গভীরভাবে আলোচনা।


কিডনি রোগের মূল কারণসমূহ

কিডনি রোগের পেছনে যেসব প্রধান কারণ কাজ করে, তার মধ্যে রয়েছে—নিয়ন্ত্রণহীন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা, নেফ্রাইটিস, অনিয়মিত ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান, ব্যথানাশক ওষুধের অতিরিক্ত ব্যবহার, জন্মগত ও বংশগত কিডনি সমস্যা, মূত্রতন্ত্রে সংক্রমণ এবং কিডনির পাথর। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এসব অধিকাংশ কারণই দৈনন্দিন জীবনের অসচেতন অভ্যাসের ফল। কিছুটা সাবধানতা অবলম্বন করলে এই বিপদ থেকে সহজেই বাঁচা সম্ভব। 

উপসর্গ ও লক্ষণসমূহ
সাধারণত, কিডনি ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ বিকল না হওয়া পর্যন্ত এর তেমন কোনো উপসর্গ বোঝা যায় না। তবে কিছু লক্ষণ দেখা দিলে কিডনির সমস্যা সন্দেহ করা উচিত:

  • প্রস্রাবের রঙে পরিবর্তন বা পরিমাণ কমে যাওয়া।

  • পা, চোখের নিচে বা গোড়ালিতে ফোলা ভাব।

  • বারবার ক্লান্তি বা দুর্বলতা অনুভব।

  • শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া।

  • বমি ভাব, অরুচি বা বমি।

  • শরীরে চুলকানি হওয়া, বিশেষ করে কোনো কারণ ছাড়াই।

  • রাতে ঘন ঘন প্রস্রাব, প্রস্রাবে ফেনা বা রক্ত, প্রস্রাবের সময় জ্বালাপোড়া।

  • কোমরের এক পাশে বা তলপেটে ব্যথা অনুভব।

শিশুদের ক্ষেত্রেও জন্মগত কোনো ত্রুটি আছে কি না, তা শুরুতেই পরীক্ষা ও চিকিৎসা করানো উচিত।

কিডনি বিকল প্রতিরোধে করণীয়
একবার কিডনি পুরোপুরি বিকল হলে তখন বাঁচার জন্য বিকল্প থাকে কেবল ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপন। কিন্তু এই চিকিৎসা এত ব্যয়বহুল যে, আমাদের দেশে মাত্র ১০ শতাংশ রোগীও এর খরচ বহন করতে পারেন না। তবে সচেতনতা ও সময়মতো চিকিৎসার মাধ্যমে প্রায় ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে কিডনি বিকল প্রতিরোধ করা সম্ভব।

প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত করতে হলে আগে ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের সনাক্ত করতে হবে। যেমন—যাঁদের ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, যাঁদের পরিবারে কিডনি রোগের ইতিহাস আছে, ধূমপান বা মাদক গ্রহণ করেন, স্থূলতা রয়েছে, দীর্ঘদিন ব্যথার ওষুধ খেয়েছেন, বারবার কিডনির পাথর বা মূত্রনালির সংক্রমণ হয়েছে, এমনকি ৪০ বছরের বেশি বয়স যাঁদের—তাঁরা সকলেই উচ্চ ঝুঁকিতে। বছরে মাত্র দুইটি পরীক্ষা—প্রস্রাবে প্রোটিন আছে কি না এবং রক্তের ক্রিয়েটিনিন—এই দুটি পরীক্ষায় প্রাথমিক পর্যায়ে কিডনি রোগ ধরা যায়। ক্রিয়েটিনিনের মাধ্যমে ইজিএফআর হিসাব করে কিডনির কার্যকারিতা শতকরা কত ভাগ, তা নির্ধারণ করা যায়।

সচেতন থাকুন, কিডনি বাঁচান
কিডনি রোগের প্রভাব ভয়াবহ এবং চিকিৎসা ব্যয়বহুল। চিকিৎসা না করলে মৃত্যু অনিবার্য, আবার চিকিৎসা করাতে গেলে আর্থিক দিক দিয়ে বিপর্যয় নেমে আসে। তাই আমাদের উচিত সচেতন হওয়া, নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা করানো এবং সুস্থ জীবনযাপন গড়ে তোলা। এতে করে কেবল নিজেকে নয়, পুরো জাতিকেও স্বাস্থ্যবান রাখা সম্ভব হবে।

কিডনি সুস্থ রাখার ৮টি কার্যকর উপায়
১. নিয়মিত ব্যায়াম বা দৈহিক সচলতা বজায় রাখা। দিনে অন্তত ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে পাঁচ দিন দ্রুত হাঁটুন।
২. সুষম খাদ্য গ্রহণ, ওজন নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত শাকসবজি ও ফল খাওয়া এবং অতিরিক্ত লবণ বা চর্বিজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলা।
৩. ডায়াবেটিস রোগীদের HbA1c সাতের মধ্যে রাখা, নিয়মিত রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষা করা।
৪. চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ব্যথানাশক বা অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ সেবন না করা।
৫. ধূমপান ও মাদক সম্পূর্ণরূপে পরিহার করা।
৬. ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের প্রতি ছয় মাসে কিডনি পরীক্ষা করানো।
৭. উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা, বিশেষ করে ১৩০/৮০ বা তার নিচে, আর প্রস্রাবে অ্যালবুমিন থাকলে ১২০/৭০–এর নিচে রাখতে হবে।
৮. পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি পান করা, পানিশূন্যতা এড়িয়ে চলা।

কিডনি ভালো রাখতে হলে আমাদের প্রত্যেককে সচেতন হতে হবে, নিজের ও পরিবারের প্রতি যত্নবান হতে হবে। এই রোগ প্রতিরোধযোগ্য—শুধু প্রয়োজন সঠিক সময়ে পদক্ষেপ নেওয়া।

No comments

Powered by Blogger.