যে সব খাবার চিনির থেকেও ক্ষতিকর

 বর্তমান বিশ্বে ডায়াবেটিস একটি ক্রমবর্ধমান নিরব ঘাতক । প্রতিনিয়ত নতুন নতুন মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এই নিরব ঘাতক, ডায়াবেটিসে । ডায়াবেটিস আমাদের দেহে শুধু নিজেই একটি রোগ, তা কিন্তু নয় । এটি অন্য অসুখেরও অনুঘটক । অর্থাৎ এই ডায়াবেটিস অন্য আরোও মারাত্মক অসুখ ডেকে নিয়ে আসে । যখনি আমরা জানতে পারি, আমাদের ডায়াবেটিস এটাক করেছে, আমরা সাথে সাথেই চিনি খাওয়া কমিয়ে দেই কিংবা চিনিকে এড়িয়ে চলি ।


কিন্তু আমারা চিনি খাওয়া কমিয়ে দিলে কি হবে, আমরা এমন কিছু খাবার দাবার খাই, যেগুলো চিনির থেকেও মারাত্মক । প্রিয় দর্শক হ্যাঁ এমন কিছু খাবার আছে, যেগুলো আমরা হরহামেশাই খাই কিন্তু এগুলোতে আমাদের ডায়াবেটিসের মাত্রা নিমিশেই বেড়ে যায় । অর্থাৎ এই সমস্ত খাবার দাবার আমাদের ডায়াবেটিস, চিনির থেকেও দ্রুত বাড়িয়ে দেয় ।

আজকের আর্টিকেলে আমি এমন কিছু খাবার দাবার নিয়ে আলাপ করবো, যে সমস্ত খাবার ডায়াবেটিস প্যাসেন্টের জন্য চিনির থেকেও মারাত্মক ক্ষতিকর । অর্থাৎ এই সমস্ত খাবার চিনির থেকেও দ্রুত আমাদের ডায়াবেটিস বাড়িয়ে দেয় । সম্মানিত ভাই ও বোনেরা এই সমস্ত খাবার সম্পর্কে যদি আপনারা জানতে চান, তাহলে শেষ পর্যন্ত আমাদের সাথেই থাকুন । আশা করি আপনার নিজের ডায়াবেটিস না থাকলেও, একজন ডায়াবেটিস প্যাসেন্টকে আজকের লেখা পড়ে, তাদের সতর্ক বা সাহায্য করতে পারবেন । আজকে আমি আপনাদের ৭টি খাবার সম্পর্কে জানাতে চলেছি যে খাবার গুলো ডায়াবেটিসের মাত্রা চিনির থেকেও দ্রুত বাড়িয়ে দিতে পারে, যে গুলো খেলে ডায়াবেটিস হুহু করে বেড়ে যায় । তো চলুন শুরু করা যাক ।

আমরা যারা ডায়াবেটিস প্যাসেন্ট, তাদের খাবার তালিকা করার সময় কিছু জিনিষ, আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে । ডায়াবেটিস প্যাসেন্টের খাবার তালিকা করার সময় গ্লাইসেমিক ইন্ডেক্স, কার্বোহাইড্রেট এবং ফাইবার এই তিনটা জিনিষ অবশ্ব্যই ফলো করে খাবার নির্বাচন করতে হবে । অর্থাৎ যে সমস্ত খাবারের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৫৫ বা তার কম, কার্বোহাইড্রেটের ও সুগারের পরিমাণ কম এবং ফাইবারের মাত্রা বেশি, এই জাতীয় খাবার ডায়াবেটিস প্যাসেন্টের জন্য নির্বাচন করতে হবে ।

খাবারের কথা বলতে গেলে সবার আগে বলতে হয় মুরির কথা । কেননা এই মুরি শহর কিংবা গ্রাম, সব জায়গাতেই আমারা প্রচুর খেয়ে থাকি । ডায়াবেটিস প্যাসেন্টের সবার আগে বাদ দিতে হবে এই সহজ লভ্য মুড়িকে । আসুন জেনে নিই কেন মুড়িকে ডায়াবেটিস রোগীর খাবার তালিকা থেকে বাদ দিবো বা একেবারেই কম খাবো । চিনির গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৬৫ আর আমাদের নিয়মিত খাবার মুড়ির গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৯০ । অর্থাৎ যে খাবারটির গ্লাইসেমিক ইনডেক্স যত বেশি, সেই খাবারটি আমাদের শরীরে ব্লাড সুগার ততই তাড়াতাড়ি বাড়াতে পারে । চিনির গ্লাইসেমিক ইনডেক্স যেখানে ৬৫, সেখানে মুড়ির গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৯০ এবং গ্লাসেমিক লোড ৮১ । অতএব বুঝতেই পারছেন চিনির থেকে মুড়ি কত বেশি দ্রুত ব্লাড সুগার বাড়াতে পারে ।

একজন ডায়াবেটিস প্যাসেন্ট সারাদিন যে খাবার খেয়ে থাকে, তার সারা দিনের সমস্ত খাবারের গ্লাইসেমিক লোড হলো ১০০ । তার মানে একজন মানুষ যদি সারাদিন ১০০গ্রাম মুড়ি খেয়ে থাকেন, তাহলে তার সারাদিনের গ্লাইসেমিক লোডের যে লিমিট, সেটার ৮০ ভাগ পুরা করে থাকে, এই ১০০ গ্রাম মুড়ি । কি বুঝলেন ? বুঝতেই পারছেন মুড়ি ডায়াবেটিস প্যাসেন্টের জন্য কত খানি ক্ষতিকর । তাই বলে একজন স্বাভাবিক সুস্থ মানুষের জন্য মুড়ি খেতে কোনো বারন নেই । স্বাভাবিক সুস্থ মানুষ নির্ধিদায় খেতে পারেন এই মুড়ি । কিন্তু যাদের ডায়াবেটিস আছে তারা মুড়ি যতো কম খেতে পারেন, ততোই আপনার জন্য মঙ্গল ।

অনেক ডায়াবেটিস প্যাসেন্ট সকাল বেলা দুধ দিয়ে কর্নফ্লেক্স খেয়ে থাকেন । তারা ভেবে থাকেন চিনি ছাড়াই এটা খাচ্ছি, তাই ডায়াবেটিসে এটি কোনো সমস্যা তৈরী করবে না । কিন্তু আপনি হয়তো জানেন না, যে কর্নফ্লেক্স আপনি চিনি ছাড়া দুধ দিয়ে খাচ্ছেন, সেই কর্নফ্লেক্সের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কতো ? যেখানে চিনির গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৬৫, সেখানে কর্নফ্লেক্সের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৮০ থেকে ৮৫ । তাই যদি আপনার ডায়াবেটিস থাকে, তাহলে আপনি কর্নফ্লেক্স যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতে পারেন ।

আমরা যখন জানতে পারি, যে আমাদের ডায়াবেটিস আছে, তখন সবার আগে আমরা যেটা করি । তাহচ্ছে চায়ের সাথে চিনি খাওয়া কমিয়ে দেই । সকালে আমরা নাস্তায় চিনি ছাড়া এক কাপ চা নিয়ে বসে পড়ি কিন্তু সঙ্গে নিয়ে থাকি বিস্কুট । আপনি এক কাপ চা নিয়ে চিনি ছেড়েছেন বটে, কিন্তু আপনি কি জানেন, যে চায়ে আপনি বিস্কুট নিয়ে বসেছেন, সেই বিস্কুট আপনার ডায়াবেটিস বাড়িয়ে দিতে পারে । এর কারণ যে বিস্কুট আপনি খাচ্ছেন তাতে হয়তো চিনি কম দেয়া হয়েছে । কিন্তু এগুলো তৈরীর যে উপাদান, তাতে আছে ময়দা, চিনি এবং তেল । এ ছাড়াও অনেকে চিনিমুক্ত বিস্কুট খেয়ে থাকেন । কিন্তু ঐযে বললাম বিস্কুট তৈরীর উপাদান ময়দা । আর এই ময়দার গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৭০ থেকে ৭৫ চিনির থেকেও বেশি । তাই এটি চিনির থেকেও দ্রুত আপনার ডায়াবেটিস বৃদ্ধি করতে পারে । আর বিস্কুটের যে তেল সেটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হচ্ছে স্যাচুরেটেড ফ্যাট । যে স্যাচুরেটেড ফ্যাট আমাদের কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, হার্টের ক্ষতি করতে পারে এমনকি ইনসুলিন রেসিসটেন্সের মতো সমস্যা বানাতে পারে । সুতরাং আপনি ডায়াবেটিস প্যাসেন্ট হয়ে থাকলে, আজ থেকেই বিস্কুট টোস্ট এই জাতীয় খাবার গুলো আপনার এড়িয়ে চলা শুরু করা উচিৎ ।

ডায়াবেটিস রোগীরা অন্যান্য খাবারের মতো ফল খেতেও সচেতন থাকেন । তারা জানেন ফলের ভেতর যে সুগার থাকে সেটা ডায়াবেটিস বাড়াতে পারে সহজেই । তবে যে সব ফলের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৫৫ এর নিচে এবং যেই সমস্থ ফলে ফাইবারের মাত্রা বেশি থাকে, সেই সমস্থ ফল তারা সতর্কতার সাথে খেতে পারেন । তবে ফলের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৫৫ এর নিচে এবং ফাইবারের মাত্রা বেশি থাকলেও, আপনাদের এই সব ফলের জুস না খাওয়াই উত্তম । কারণ যখন আপনি ফলের জুস বানাতে যাবেন, তখন এই জুস ফিল্টার হবে, ফলে এতে ফাইবারের মাত্রা কমে যাবে এবং আপনার শরীরে সুগারের মাত্রা দ্রুতই বাড়িয়ে দিবে । তবে এই ফল গুলো আপনি গোটা বা ছাল সহ খাওয়ার চেষ্টা করতে পারেন ।

আলু আমাদের শরীরে সুগারের মাত্রা দ্রুতই বৃদ্ধি করতে পারে । কেননা আলুর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৭৮ । তাই আলু বা আলুর ভর্তা থেকে আপনি যতটা পারেন দূরে থাকার চেষ্টা করবেন । তবে আলু খাওয়ার সময় আপনি একটা কাজ করতে পারেন । সবজির সাথে আলু খেতে পারেন । এতে সবজিতে থাকা ফাইবার আলুর কার্বোহাইড্রেটকে সহজেই শোষন করতে বাধগ্রস্থ করবে । ফলে রক্তে সুগারের মাত্রা সহজেই বাড়তে পারবে না । কিন্তু আপনি ডায়াবেটিস রোগী হলে, যদি আলু ভর্তা খেতে চান, তাহলে আপনাকে একটু কষ্ট করতে হবে । আপনার ভর্তার আলু সেদ্ধ করে ফ্রিজে ৮ থেকে ১০ ঘন্টা রেখে দিতে হবে । এরপর এই ভর্তার আলু ফ্রিজ থেকে বের করে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় আনতে হবে । তারপর আপনি সেই আলু, ভর্তা করে খেতে পারেন । ততক্ষণে এই আলু রেজিস্টেন্স স্টার্চে রুপান্তরিত হয়ে পরবে । ফলে এটি সহজেই শোষিত হবে না এবং এবজর্ব না হলে এটি সুগারের মাত্রাও সহজেই বর্ধিত করতে পারবে না । তবে সাবধান ফ্রিজ থেকে বের করা আলু দ্বিতীয়বার গরম করতে যাবেন না ।

আমরা অনেকেই মনে করি তরমুজ ডায়াবেটিস প্যাসেন্ট বাধা ছাড়াই খেতে পারি । কেননা আমরা মনে করি এর বেশিরভাগই জলীয় আংশ অর্থাৎ পানি । কিন্তু না এই তরমুজও আমাদের ডায়াবেটিস প্যাসেন্টের সুগারের মাত্রা সহজেই বাড়াতে পারে । এর কারণ এই তরমুজের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৭২ হলেও এতে কার্বোহাইড্রেটের মাত্রা থাকে কম । ১০০ গ্রাম তরমুজে কার্বোহাইড্রেট থাকে মাত্র ৮ গ্রাম । এতে কার্বোহাইড্রেট কম থাকায় এর গ্লাইসেমিক লোড ৫ থেকে ৬ । তাই আপনি ডায়াবেটিস রোগী হয়ে থাকলে, সারা দিনে ১০০ থেকে ১৫০ গ্রাম তরমুজ বিনা দ্বিধায় খেতে পারেন । এর বেশি খাওয়া আপনার জন্য মোটেও নিরাপদ হবে না ।

সবশেষে আসছি গুড়ের কথায় । আমরা অনেকেই চিনির পরিবর্তে গুড় খাওয়াটা ডায়াবেটিস প্যাসেন্টের জন্য নিরাপদ মনে করি । কিন্তু গুড় চিনির থেকেও বেশি ব্লাড সুগার বাড়াতে পারে । কারণ যেখানে চিনির গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৬৫ সেখানে গুড়ের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৮৪ । সুতরাং আপনারাই বলুন কেন গুড় চিনির থেকেও তাড়াতারি ব্লাড সুগার বাড়িইয়ে দিতে পারে । এ ছাড়াও চিনি এবং গুড়ের ক্যালরি প্রায় সমান । ১০০গ্রাম চিনিতে ক্যালরি ৩৮৭ আর গুড়ে ক্যালরি থাকে ৩৮৩ গ্রাম । তবে গুড় খেলে আপনি কিছুটা ক্যালসিয়াম, প্রোটিন এবং আয়রন পেতে পারেন । কিন্তু ডায়াবেটিস প্যাসেন্টেদের জন্য ক্ষতির কথা চিন্তা করলে চিনি এবং গুড় সমান ক্ষতিকর । আর একটি কথা বলে রাখা ভালো খেজুর গুড়, তালের গুড়, মিশ্রি, বাতাসা কিংবা মধু এ গুলো সবই চিনির মতো ডায়াবেটিস প্যাসেন্টের জন্য ক্ষতিকর । তাই এগুলো যতই কম খাবেন ততই আপনার জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে ।

আশা করি লেখাটা আপনাদের ভালো লেগেছে, যদি ভালো লেগে থাকে তাহলে একটা লাইক দিবেন । আর বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজন্দের সাথে শেয়ার করে পড়ার সুযোগ করে দিবেন । আল্লাহ সকল অবস্থায় আমাদের সহায় হোক -আমিন ।








No comments

Powered by Blogger.