যে সব খাবার লিভারের জন্য বিষ

লিভার বা যকৃৎ মানুষের শরীরের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ । এই লিভার যেমন আমাদের খাবার হজমে সাহায্য করে । তেমনি আমাদের শরীর থেকে দূষিত পদার্থ বের করে দেয় । রক্ত ফিল্টার করে, প্রোটিন সিনথেসিস করে । ভবিষ্যতের জন্য দরকারী কার্বোহাইড্রেট, ভিটামিন, মিনারেল ইত্যাদি নিজের কাছে জমা করে রাখে । এই রকম আরোও প্রায় অসংখ্য অসংখ্য বেশি কার্যকলাপ আছে লিভারের । যে কার্যকলাপের কারণে আমাদের শরীর সুস্থ থাকে । সুতরাং আমরা বুঝতে পারছি, আমাদের সুস্থভাবে জীবনযাপনের জন্য লিভার সুস্থ রাখা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ।

কিন্তু আমাদের অজ্ঞতার কারণে কিংবা অভ্যাসের কারণে আমরা দৈনন্দিন এমন কিছু খাবার খাই, যে খাবার গুলো আমাদের লিভারকে মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করত পারে । শুধু তাই নয় এই খাবার গুলি আস্তে আস্তে আমাদের লিভারকে পুরোপুরি নষ্ট করে দিতে পারে ।

আজকের ভিডিওতে আমি আপনাদের লিভারের ক্ষতি করে এই রকম ৭টি খাবার নিয়ে আলাপ করবো । যে খাবার গুলো আমরা দৈনন্দিন খাবার মেনুতে রেখে, দীর্ঘদিন ধরে খাওয়া চালিয়ে যাই এবং যে খাবার গুলো আমাদের লিভার নষ্টও পর্যন্ত করতে পারে । ভিডিওটি না টেনে ধৈর্যধরে শষ পর্যন্ত দেখতে থাকুন আর যেনে নিন, দৈনন্দিন আপনি যে সব খাবার খাচ্ছেন, সেই সব খাবারের মধ্যে এমন সব খাবার আছে কিনা, যেগুলি আপনার লিভারের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ ।

তো চলুন জেনে নেয়া যাক কোন খাবার গুলো আমাদের লিভারের জন্য মারাত্মক হুমকিঃ

১ । আপনার লিভার সুস্থ রাখতে যে খাবারটি সবার আগে এড়িয়ে চলার কথা বলবো, সেটি হচ্ছে, মিষ্টি, মিষ্টিজাতীয় খাবার । মিষ্টি মিষ্টি জাতীয় খাবার অর্থ হচ্ছে রিফাইন সুগার । আর রিফাইন সুগার মানেই হচ্ছে সুক্রোজ । এই রিফাই সুগারের ভেতর দিয়ে আমাদের দেহে যে সুক্রোজ প্রবেশ করে, সে সুক্রোজ আমাদের দেহে প্রবেশের পর, ফ্রুক্টোজ এবং গ্লুকোজ বিভক্ত হয়ে যায় । এই সুক্রোজ বিভক্ত হয়ে যে ফ্রুক্টোজ হয়, সেই ফ্রুক্টোজ কে আমাদের লিভার লাইপোজেনেসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খুব সহজেই চর্বি বা ফাটে রুপান্তরিত করে ।এবং এই চর্বি বা ফ্যাট আমাদের দেহের সাথে সাথে লিভারেও গিয়ে জমা হয় । এর ফলে আমাদের ফ্যাটি লিভারের মতো সমস্যা তৈরী হয় । এই সমস্যাকেই বলা হয়ে থাকে নন-এলকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিস বা নন-এলকোহলিক ফ্যাটি লিভার অসুখ । কিন্তু আপনি হয়তো জানেন না এই নন এলকোহলিক ফ্যাটি লিভার অসুখ, সময় মতো চিকিৎসা না করলে, এই ফ্যাটি লিভার থেকে আস্তে আস্তে লিভার ফাইব্রোসিস, লিভার সিরোসিস, লিভার ক্যানসার, এমন কি আপনার লিভার নষ্ট পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে । সুতরাং এই ফ্যাটি লিভার ডিজিসকে কোন ক্রমেই ছোট খাটো সমস্যা মনে করে এড়িয়ে যাবেন না ।

অতএব এই মিষ্টি মিষ্ট জাতীয় খাবার আপনার খাবার তালিকা থেকে ছেটে ফেলুন । খেয়াল করুন এই মিষ্টি বা মিষ্টি জাতীয় জিনিষের মধ্যে আমরা প্রায়ই যে সব জিনিষ খাই, সেগুলো হচ্ছে চায়ের সাথে চিনি বা কফির সাথে চিনি, যে কোন প্রকার কার্বেনেটেড ড্রিংক্স বা সফট ড্রিংস । এ ছাড়াও বাজারে যে সমস্ত প্যাকেটজাত বা বোতলজাত ফ্রুট জুস পাওয়া যায়, সে গুলোর ভেতর প্রচুর পরিমানে চিনি মেশানো হয় । এ গুলো আমাদের লিভারের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর । এ গুলো ছাড়াও আইসক্রিম পেস্ট্রি বা বিভিন্ন জাতের মিষ্টি জিনিষ আমাদের মোটেও খাওয়া উচিৎ নয় । যদি আমরা আমাদের দেহকে সুস্থ রাখতে চাই, আমাদের লিভারকে সুস্থ রাখতে চাই ।

২ । আমরা সামান্য একটু হলেই এসিডিটির জন্য ওষুধের দোকানে গিয়ে গ্যাসের বড়ি কিনে খাই । কিন্তু আমরা কি জানি কোন ধরনের গ্যাসে বড়ি আমাদের কি ধরনের গ্যাসের কাযে লাগে । সরাচর বাজারে এসিডিটি কমানোর জন্য যে বড়ি পাওয়া যায়, এ গুলো হচ্ছে প্রটন পাম্প ইনহিবিটর, H2 রিসেপটর এন্টাগনিস্ট এবং লিকুইড এন্টাসিড । যে গ্যাসের বড়ি গুলো প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর কিংবা H2 রিসেপটর এন্টাগনিস্ট সে গুলোর নির্ধারিত পরিমান ডোজ যদি সঠিক ক্ষেত্রে ব্যবহার না হয়, অথবা এই সব ওষুধ যদি আপনি দীর্ঘদিন ধরে খেয়ে যান । তাহলে সে গুলো আপনার পুরো দেহের মতো আপনার লিভারকেও নষ্ট করে দিতে পারে । তাই অযথাই হরহামেসা কোন ধরনের গ্যাসের বড়ি খেতে যাবেন না । যদি কোন গ্যাসের বড়ি আপনাকে দীর্ঘদিন ধরে খাওয়া চালিয়ে যেতে হয়, তাহলে অবশ্যই অবশ্যই কোন চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাওয়া চালিয়ে যেতে হবে । না হলে আপনি আপনার লিভার হারাতে পারেন ।

৩ । অনেক সময় আমাদের চোখের কারণে বা আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কিংবা বাড়ন্ত বাচ্চাদের চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকেরা অনেক সময় ভিটামিন এ সাপ্লিমেন্ট সুপারিশ করে থাকেন বা প্রেসক্রাইব করে থাকেন । যে সমস্ত সমস্যার জন্য প্রেসক্রাইব করে থেকেন । সেই সমস্যা সমাধান হওয়ার পরেও, ভিটামিন এ সাপ্লিমেন্ট আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী এই ভাবনা থেকে আমরা আরোও দীর্ঘদিন খেতেই থাকি । এ ছাড়াও পরবর্তিতে একই সমস্যা ফেস করলে আমরা এই সব ভিটামিন এ সাপ্লিমেন্ট কিনে খাওয়া শুরু করি । কিন্তু আমরা কি জানি এই ভিটামিন এ সাপ্লিমেন্ট দীর্ঘদিন ধরে খেতে থাকলে, আপনার লিভারের কোষ আস্তে আস্তে নষ্ট হতে থাকে । এমনকি আপনি দীর্ঘদিন থেকে ভিটামিন এ সাপ্লিমেন্ট বেশি মাত্রায় খেতে থাকলে এক সময় আপনার লিভার সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে । তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া দীর্ঘদিন ভিটামিন এ সাপ্লিমেন্ট এবং যে সমস্ত মাল্টি ভিটামিনে ভিটামিন এ আছে, এই ধরনের মাল্টিভিটামিন দীর্ঘদিন খাওয়া চালিয়ে যাওয়া মোটেও উচিৎ হবেনা ।

ভিটামিন এ একান্তই যদি আপনি পেতেই চান । তাহলে প্রাকৃতিক উৎস থেকে খাওয়ার মাধ্যমে সংগ্রহ করতে পারেন । যত রকমের হলুদ, লাল এবং কমলা রঙের সবজি ও ফলমূল বিদ্যমান সেগুলোর ভেতর এই ভিটামিন এ প্রচুর পরিমাণ পাওয়া যায় । তাই এ গুলি আপনি যত খুশি খেতে পারেন । যখন আপনি প্রাকৃতিক উৎস থেকে এই ভিটামিন এ সাপ্লিমেন্ট আপনার দেহে প্রবেশ করাবেন, সেগুলো কিন্তু আপনার দেহে মোটেও পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে না । কিন্তু ভিটামিন এ সাপ্লিমেন্ট দীর্ঘদিন আপনি কখনোই খেতে যাবেন না ।

৪ । ট্রান্স ফ্যাট যেমন আমাদের হার্টের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি এটি আমাদের লিভারের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর । ট্রান্স ফ্যাট বলতে সাধারণত সমস্ত প্রকারের ভাজাপোড়া খাবার কে বুঝায় । যেমন সিংগারা, সমচা, ঝিলাপি, চপ এবং সেই সাথে সমস্ত প্রকার ফাস্ট ফুড । অর্থাৎ বাজার থেকে কিনে আনা পিজা, বার্গার, বিফরোল, চিকেন বার্গার এই সব খাবারে প্রচুর ট্রান্স ফ্যাট বিদ্যমান । এ ছাড়াও বাজারে যে সমস্ত বেকারি পণ্য পাওয়া যায় যেমন পাউরুটি, বিস্কুট, পেস্ট্রি, কুকিজ এ গুলোর মধ্যেও প্রচুর ট্রান্স ফ্যাট থাকে । তাই এ গুলো যতটা সম্ভব এড়িয়ে যাবার চেষ্টা চালাতে হবে ।

৫ । লাল মাংস বা রেড মিট আপনার লিভারের জন্য হুমকি হতে পারে । লাল মাংস বা রেড মিট বলতে সাধারণত গরুর মাংস, ছাগলের মাংস, ভেড়ার মাংস এ গুলি বোঝায় । এই রেড মিট একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ প্রত্যেক দিন ৭০ গ্রাম করে সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিনের বেশি খায়, তাহলে এটি আপনার লিভারের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে । এ ছাড়াও রেড মিট লিভারের জন্য হজম করতেও সমস্যা হয় । এটি প্রচুর পরমান প্রোটিন সমৃদ্ধ একটি খাবার । এটি লিভারের জন্য বিভক্ত করা কষ্ট সাধ্য হয়ে পড়ে এবং অতিরিক্ত পরিমাণ প্রোটিন যখন লিভারে গিয়ে জমা হয়, তখন লিভারে নন-এলকোহলিক ফ্যাটি লিভারের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে । সুতরাং কোন অবস্থাতেই রেডমিট বা লাল মাংস বেশি বেশি খেতে যাবেন না ।

৬ । লবণ আমাদের দেহের জন্য যেমন জরুরী তেমনি রান্নার জন্য অপরিহার্য একটি উপাদান । লবণ ছাড়া আমরা রান্নার কথা কল্পনাও করতে পারি না । কিন্তু এই লবণ আপনি রান্নায় ব্যবহার করছেন তাতে সমস্যা নাই । কিন্তু বিপত্তিটা সেখানেই যারা কাঁচা লবণ খান বা প্রতিনিয়ত নোনতা জাতীয় খাবার খান । যেমন নোনত বিস্কুট, নোনতা টোস্ট, চিপস, চানাচুর ইত্যাদি । এ গুলো খাবারের ভেতর প্রচুর লবণ থাকে । এই লবণের সোডিয়াম আমাদের লিভারের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর । কারণ এই সোডিয়াম আমাদের লিভারের কোষ গুলিকে বিকৃত করে তোলে, ফলে আমাদের লিভারের সেল ড্যামেজের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং লিভারের সেল বৃদ্ধির মাত্রাও কমে যেতে থাকে । অর্থাৎ একটি সেল ভেঙ্গে দুইটি সেল হওয়ার প্রক্রিয়া কমে যেতে থাকে । যার ফলে একটি সেল নষ্ট হলে তার পরিবর্তে আরোও সেল তৈরী হতে বাধাগ্রস্থ হয় । সুতরাং অতিরিক্ত লবণ এবং লবণ জাতীয় খাবার থেকে যতই দূরে থাকবেন ততই মঙ্গল ।

৭ । সবার শেষে যে খাবারটি নিয়ে আলাপ করবো, সেটি আমাদের লিভারের পক্ষে ক্ষতিকর সেটা আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই জানে । তার পরেও অনেক মানুষ এই খাবারটিতে আসক্ত হয়ে পড়ে । এই খাবারটি হচ্ছে এলকোহল । আমরা সাধরণত যেটাকে মদ বলে থাকি এবং এটি যে ক্ষতিকর সেটা নতুন করে বলার কিছু নাই । এই অ্যালকোহলের কারণে আমাদের শরীরের সাথে সাথে লিভারেও ফ্যাট জমা হতে থাকে । যেটিকে অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিস বলা হয়ে থাকে । অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিস থেকে আপনার লিভার সিরোসিস বা লিভার ক্যানসার খুব সহজেই হয়ে যায় । যতবার লিভার অ্যালকোহলকে ফিল্টার করে ততোবার লিভারের কিছু সেল ড্যামেজ ঘটে । কিন্তু লিভার স্বয়ংক্রিয় ভাবে নতুন সেল তৈরী করতে পারে অর্থাৎ লিভারের কোন অংশের সেল ক্ষতিগ্রস্থ হলে সেই সেলের ঘাটতি লিভার স্বয়ংক্রিয় উপায়ে সম্পূর্ণ করতে পারে । তাই কোন কারণে লিভার ক্ষতিগ্রস্থ হলে লিভার নিজে নিজেই সেই ক্ষতি কাটিয়ে উটতে পারে । কিন্তু অতিরিক্ত পরিমাণে অ্যালকোহল খেতে থাকলে, সেই অ্যালকোহলের কারণে লিভারে যে সেল ড্যামেজ হয়, সেই পরিমাণ সেল লিভার তৈরী করতে পারে না । ফলে আস্তে আস্তে লিভার নষ্ট হয়ে যায় । এক সমীক্ষায় দেখা গেছে প্রতি তিনজন অ্যালকোহল পানকারীর মধ্যে একজনের লিভার ড্যামেজ হয়ে মৃত্যু ঘটে । তাই সুস্থভাবে বেচে থাকতে চাইলে আজ থেকেই অ্যালকোহল খাওয়া বাদ দিয়ে দিন ।

আশা করি লেখাটি আপনাদের ভাল লেগেছে । যদি ভাল লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই একটা লাইক দিবেন । আর বন্ধু বান্ধব আত্বীয় সজনদের সাথে শেয়ার করতে একদম ভুলবেন না । কথা হবে পরের কোন এপিসোডে । আল্লাহ সকল অবস্থায় আমাদের সহায় হোক ।

No comments

Powered by Blogger.