ডায়াবেটিস রোগ প্রতিরোধের ৫টি উপায়
ডায়াবেটিস হচ্ছে নিরব ঘাতক । কারণ ডায়াবেটিস নিজে তো আক্রান্ত ব্যক্তিকে ধ্বংস করেই, সেই সাথে আক্রান্ত ব্যক্তির কিডনি এবং হার্টকেও আস্তে আস্তে অসুস্থ করে । এ ছাড়াও শারীরিক আরো নানান বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসে । সবচেয়ে যেটা হতাশার সেটা হচ্ছে একবার যদি এই ডায়াবেটিসে আপনি আক্রান্ত হন, তাহলে আপনাকে সারাজীবন এই রোগ বহন করতে হবে । কারণ এই রোগ চিরতরে নির্মূলের চিকিৎসা এখন পর্যন্ত মানুষের নাগালে আসেনি । অনেক সময় এই ডায়াবেটিস আপনার অকাল মৃত্যুও ডেকে নিয়ে আসে । সারা বিশ্বে প্রায় ৮৩ কোটি মানুষ বর্তমান ডায়াবেটিসে আক্রান্ত । অর্থাৎ আমাদের সারা দেশে যত মানুষ তার প্রায় ৫ গুণ মানুষ সারা দুনিয়ায় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত । বাংলাদেশে এই সংখ্যাটা ১ কোটি ১০ লাখ । গা শিউরে ওঠার মত পরিসংখ্যান । যেটা আমাদের আরোও ভাবিয়ে তোলে, সেটা হচ্ছে এই সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে । বলা যায় প্রতিটি বাড়িতে আর কিছু থাক আর না থাক ডায়াবেটিস রোগী আছে । প্রতি ৭ সেকেন্ডে বিশ্বে একজন করে মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে । ডায়াবেটিস হলে বারবার পানির পিপাসা লাগে, ঘন ঘন প্রস্রাব হতে পারে, শরীর ক্লান্ত লাগে, দৃষ্টি ঝাপসা হতে পারে এবং দেহের ওজন কমে যেতে পারে । ডায়াবেটিস রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বৃদ্ধি করে দেহের ক্ষুদ্র রক্তনালিগুলো ক্ষতিগ্রস্থ করে, দেহের বিভিন্ন অঙ্গকে মারাত্বক হুমকির মুখে ফেলে । অর্থাৎ ডায়াবেটিস মানেই আপনার জীবন দুর্বিষহ । তো এই দুর্বিষহ জীবন থেকে মুক্তি পেতে আপনাকে কি করতে হবে? ডায়াবেটিসকে প্রতিরোধ করতে হবে । ভাবছেন কিভাবে প্রতিরোধ করবেন? আপনার এই ভাবনার সূত্র ধরেই আমাদের আজকের টপিক ডায়াবেটিস প্রতিরোধ । এই ডায়াবেটিসকে আপনি কিভাবে প্রতিরোধ করবেন সেটা নিয়েই আমাদের আজকের আলাপ । চলুন শুরু করা যাকঃ
ডায়াবেটিস প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায় । টাইপ-১ ডায়াবেটিস এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিস । বস্তুত আমাদের দেশে ডায়াবেটিস রোগীর ৯৫ শতাংশই টাইপ-২ ধরনের । টাইপ-১ ডায়াবেটিস মানে হচ্ছে, যাদের দেহে মোটেও ইনসুলিন তৈরী হয় না । এই সব রোগীর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ইনসুলিন বা ওষধের উপর নির্ভর করতে হয় । আর তাই এদের সব সময় চিকিৎসকের নিবিঢ় পর্যবেক্ষণে থাকতে হয় । তবে আশার কথা হচ্ছে, টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে একটু অগ্রীম সতর্কতা অবলম্বন করলে ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা যায় । এই টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে আপনি কিভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলবেনঃ
১ । দৈনিক এক ঘন্টা হাটুনঃ
বর্তমানে আমরা অনেকটাই যান্ত্রিক হয়ে গেছি । শারীরিক পরিশ্রম আমাদের হয়না বললেই চলে । সবসময় আমরা ল্যাপটপ বা মোবাইল নিয়েই পড়ে থাকি । অর্থাৎ আমরা শুয়ে বসেই কাটাই । কিন্তু আমাদের ভেতর যাদের বাবা-মা বা ফ্যামিলী মেম্বারদের কারোও ডায়াবেটিস আছে, তাদের বংশগত কারণেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি । ফলে এ ক্ষেত্রে তারা যদি নিয়মিত হাঁটাচলা বা শারীরিক পরিশ্রম করেন, তাহলে অনেক ক্ষেত্রেই তারা ডায়াবেটিসকে প্রতিরোধ করতে পারেন । বিশেষজ্ঞরা এ জন্য প্রতিদিন কমপক্ষে একঘন্টা হাঁটতে বলেন । এর পাশাপাশি আপনি নিয়মিত ব্যায়ামের চর্চা করতে পারেন । বাড়াতে পারেন শারীরিক খেলাধুলার পরিসর ।
২ । আপনার জীবনযাপনের ধরন পাল্টে নিনঃ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যাদের পরিবার বা পিতা মাতার ডায়াবেটিস হওয়ার প্রমাণ রয়েছে, তাদের এই ডায়াবেটিস রোগ ধরার আগেই জীবনযাত্রার স্টাইল পরিবর্তন করা উচিৎ । বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে সব ফ্যামিলির বাবা-মা বা দাদা-দাদী, নানা-নানীর ডায়াবেটিসের ইতিহাস আছে, তাদের পরবর্তি প্রজন্মের এই রোগে ধরার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে ।
যাদের হৃদরোগ আছে, রক্তে কোলেস্টেরল বেশি আছে বা উচ্চ রক্তচাপ আছে, তাদের ক্ষেত্রেও এই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি আছে ।
যে সমস্ত শিশুর ওজন বেশি, যাদের পিতা-মাতা, ভাই-বোন, দাদা-দাদী, নানা-নানী বা নিকট আত্মীয়সজনের ডায়াবেটিস আছে কিংবা যাদের মায়ের গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হয়েছিল, সেই সমস্ত শিশুরও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি আছে । যার কারণে এদেরও আক্রান্ত হওয়ার আগে জীবনযাত্রার স্টাইলে পরিবর্তন আনা উচিৎ ।
এই সব পরিবর্তনের ভেতর আছে নিয়মিত খাবার খাওয়া, নিয়মিত সকালে ঘুম থেকে ওঠা এবং রাতে ঘুমাতে যাওয়া, যাতায়াতে যানবাহন ব্যবহার কমিয়ে হাঁটাচলা বৃদ্ধি করা, মিষ্টি জাতীয় খাবার, ফাস্টফুড এবং তৈলাক্ত খাবার এড়িয়ে চলা ইত্যাদি ।
৩ । ধূমপান এবং অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুনঃ
ধুমপান এবং অ্যালকোহল এড়িয়ে চললে শুধু ডায়াবেটিস না, আরোও অনেক রোগের কবল থেকেও আপনি বেঁচে যাবেন । বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, ডায়াবেটিস রোগ প্রতিরোধে যে সমস্ত খারাপ অভ্যাস সবার আগে ছেড়ে দিতে হবে, তার মধ্যে রয়েছে ধূমপান এবং অ্যালকোহল পানের অভ্যাস । কারণ এই অভ্যাস গুলো আপনার ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বৃদ্ধি করে দেয় ।
৪ । মিষ্টিজাতীয় খাবার খাওয়া বাদ দিনঃ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোটা হলে বা মুটিয়ে গেলে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায় । সাধারণ মিষ্টিজাতীয় খাবার, ফাস্টফুড, কোমল পানীয় বা ভারী খাবার আপনার মুটিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বৃদ্ধি করে দেয় । তাই আপনার ওজনের দিকে খেয়াল করতে হবে, যাতে অতিরিক্ত মুটিয়ে না যান । এজন্য আপনাকে যা করতে হবে তা হচ্ছে, মিষ্টিজাতীয় খাবার, ফাস্টফুড, পোলাও, বিরিয়ানি এবং লাল মাংসের মতো খাবার এড়িয়ে চলতে হবে ।
প্রক্রিয়াজাত খাবার ও পানীয় এড়িয়ে চলুন । মসৃন সাদা আটার রুটি না খেয়ে, ভুষিওয়ালা আটার রুটি খান । এড়িয়ে চলুন হোয়াইট পাস্তা, প্যাস্ট্রি, চিনি জাতীয় পানীয়, মিষ্টি ইত্যাদি । স্বাস্থ্যকর খাবার শাক সবজি, ফল, মোটা দানার খাদ্য শস্য ইত্যাদি খেতে পারেন । বাদাম খেতে পারেন, ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড আছে যেসব মাছে সেগুলো বেশি করে খাবেন । যেমন সারডিন স্যামন ইত্যাদি । একসাথে পেট ভরে না খেয়ে বরং অল্প অল্প করে বিরতি দিয়ে খাবার খেতে পারেন । নিয়মিত প্রতি সপ্তাহে ওজন মাপুন । শরীরের জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টি ও খাবারের নিশ্চয়তার জন্য পুষ্টিবিদের সঙ্গে পরামর্শ করে খাবার তালিকা তৈরী করে নিন এবং সেটা অনুসরণ করার চেষ্টা করুন । ফলে এতে আপনার স্বাস্থ্যও ঠিক থাকবে, ওজনও নিয়ন্ত্রণে থাকবে ।
৫ । রক্তের গ্লুকোজের লেভেল নিয়মিত চেক করুনঃ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যাদের ডায়াবেটিসের ঝুঁকি আছে, তাদের অবশ্যই বছরে অন্তত একবার ডায়াবেটিস চেক করা উচিৎ । আজকাল আপনি হাসপাতালে না গিয়েও, আপনার আশ পাশের ফার্মেসীতে সহজেই ডায়াবেটিস পরীক্ষা করাতে পারেন । তাদের কাছে প্রাথমিক অবস্থায় ডায়াবেটিস ধরা পড়লে, অবশ্যই পরবর্তিতে আপনার একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিৎ । যে সমস্ত শিশুর আত্মীয়সজনদের ডায়াবেটিসে আক্রান্তের ইতিহাস আছে, তাদেরও বছরে কমপক্ষে একবার ডায়াবেটিস চেক করা উচিৎ । শুধু তাই নয় এর সাথে সাথে বছরে অন্তত একবার লিপিড প্রোফাইল এবং রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রাও চেক করা উচিত ।
যে অবস্থায় আপনাকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবেঃ
১ । ঘনঘন প্রস্রাব এবং পিপাসা লাগলে ।
২ । দুর্বল লাগলে এবং ঘোর ঘোর ভাব আসলে ।
৩ । ক্ষুধা বেড়ে গেলে ।
৪ । সময়মতো খাওয়া দাওয়া না হলে, যদি রক্তে শর্করা কমে যায়
৫ । মিষ্টিজাতীয় খাবারের প্রতি আকর্ষণ বেড়ে গেলে ।
৬ । কোন রকমের কারণ ছাড়াই ওজন কমে গেলে ।
৭ । দেহের কোন ক্ষত বা ঘা সারতে বেশি সময় লাগলে ।
৮ । চামড়া শুষ্ক, খসখসে ভাব এবং চুলকানি হলে ।
৯ । বিরক্তি ভাব এলে বা মেজাজ খিটিখিটে হয় উঠলে ।
১০ । চোখের দৃষ্টি কমতে শুরু করলে ।
এই ছিল আজকের মতো । কথা হবে পরের কোন এপিসোডে । আল্লাহ হাফেজ ।
Post a Comment